গল্প/কাহিনি: "টিউশনি" (পর্ব:৩)
-------------------------------------------
মিথিলার কপালে এবার চিন্তার ভাজ পড়লো। আর উপায় খুঁজে না পেয়ে মিথিলা এবার তার মা কে শেয়ার করলো ব্যাপার টা। মিথিলার জীবনে তার মা ই তার বেস্টফ্রেন্ড। সব শুনে মা ও ব্যাপার টা উড়িয়ে দিলো। তেমন পাত্তা দেয়নি।
এভাবে ই দিন কেটে যায়। মিথিলা আর মিসেস রায় এর সম্পর্ক টা আস্তে-ধীরে স্বাভাবিক হয়ে যায়৷ একদিন মিথিলা মজার ছলে ইচ্ছে করেই কৌতুহল বশত চিন্তা করে, আজ সে বার্গার খেতে চায় এবং যাচাই করে দেখবে মিসেস রায় সত্যিই মাইন্ড রিডিং করতে পারেন কিনা।
মিথিলা যথারীতি সৈকত কে ওদের বাসায় পড়াচ্ছিলো। পড়ার ফাঁকেই মিসেস রায় টেবিলের একপাশে নাস্তার ট্রে রেখে হাসিমুখে চলে গেলেন।আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, মিসেস রায় আজ বার্গার ই দিয়েছেন।
মিথিলা সেটা খেয়ে মিসেস রায় কে ডাকলেন এবং জিজ্ঞেস করেই বসলেন, "আপা, আজ বার্গার খেতে ইচ্ছে হচ্ছিলো। কিন্তু আপনি তা কি করে বুঝলেন?"
মিসেস রায় মুচকি হেসে বললেন, "আমি তো জানিনা। মনে হয় বোন ডেকেছি আপনাকে। এজন্যই বুঝে ফেললাম।"
মিথিলা স্বাভাবিক বলেই ধরে নেয়। কিন্তু কিছুদিন পর এক রাতে মিথিলার সাথে অদ্ভুত কিছু ঘটে।
মিথিলার লেখালেখির অভ্যাস ছিলো। প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে প্রায় অনেক রাত পর্যন্ত মিথিলা গল্প/কবিতা লেখালেখি করতো। কারণ, পরদিন শুক্রবার তাই৷
মিথিলা তার বেড রুমের দরজা বন্ধ করে একমনে লিখছিলো। ভেতর থেকে লক করা দরজা। রফিক পাশেই চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিলো। তবে গভীর ভাবে ঘুমায়নি। আজ মিথিলার লেখার টপিক ছিলো "কবর" নিয়ে। রাত তখন প্রায় ২টা। হঠাৎ করেই বেডরুমের দরজা একটু শব্দ করেই আস্তে আস্তে নিজ থেকে খুলে গেলো।
মিথিলা আঁতকে উঠে ডায়েরিটা একটু দূরে ঠেলে দিলো আর হাতের কলমটা মাটিতে পড়ে গেলো। এই প্রথম মিথিলার কোনো সুপারন্যাচারাল কিংবা অদ্ভুত কিছুর অভিজ্ঞতা হচ্ছে।
মিথিলা পাশ ফিরে চেয়ে দেখে রফিক এক দৃষ্টে সোজা হয়ে শুয়ে আছে আর সিলিং এর দিকে তাকিয়ে আছে। মিথিলা রফিক এর গায়ে হাত রেখে বলে, "রফিক, এই রফিক! কি হয়েছে তোমার?"
রফিক কিছু না বলে আবার চোখ বন্ধ করে ওপাশ ফিরে ঘুমিয়ে যায়।
কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, এইবার দরজাটা আবার "ধুপ" শব্দে লেগে যায়।
মিথিলা এবার জোরে ধাক্কা দেয় রফিক কে। "রফিক, প্লিজ উঠো। আমার ভয় করছে।"
রফিক এবার হন্তদন্ত হয়ে উঠে মিথিলা কে জিজ্ঞেস করে, "কি হয়েছে মিথিলা? খারাপ স্বপ্ন দেখেছো?"
মিথিলা বলে, "আরে আমি তো ঘুমাই ই নি। দরজাটা খুলে আবার বন্ধ হয়ে গেলো। আর তুমি উপরের দিকে তাকিয়ে ছিলে। নিশ্চয়ই কিছু একটা আছে এখানে।"
রফিক মিথিলাকে ধরে বলে, "রিলাক্স। কিচ্ছু হয়নি। আমি বোধ হয় ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখছিলাম। আর দরজাটা তো বাতাসেও খুলে আবার লেগে যেতে পারে। দেখো, বাইরে ঠান্ডা বাতাস বইছে।"
মিথিলা খেয়াল করে দেখলো, সত্যিই বাতাস হচ্ছে বাইরে। কিন্তু ও তো লক করে রেখেছিলো ভেতর থেকে। যদি দরজা খুলতেই হয় তাহলে বাহির থেকে কারোর দরজা খোলা অসম্ভব। আর আবার দরজা বন্ধ হলোই বা কি করে?
মিথিলা রফিক কে বললো, "তুমি একবার বেডরুম থেকে বাইরে যাবে, প্লিজ?"
রফিক বললো, "কেন?"
মিথিলা বললো, "তোমাকে একটা জিনিস দেখাচ্ছি।"
রফিক এবার একটু বিরক্ত হয়েই উঠে দরজার বাইরে গেলে মিথিলা বলে, "আমি দরজা এবার ভেতর থেকে লক করছি। তুমি দেখো খুলতে পারো কিনা।"
মিথিলা এবার ভেতর থেকে লক করে দিলে রফিক আর বাহির থেকে দরজা খুলতে পারেনা। এমনকি ধাক্কাধাক্কি করেও দরজা খুলতে সক্ষম হলোনা। এবার মিথিলা ভেতর থেকে দরজা খুলে রফিক কে বলে, "তাহলে এবার ভাবো। দরজাটা আপনা-আপনি কিভাবে খুললো? আমি নিজের চোখে দেখেছি দরজাটা আস্তে করে নিজে নিজে খুলছে।"
রফিক বললো, "সবটাই তোমার কল্পনা। শোনো, এমনিতেই সারাদিন কাজ করেছো। এখন রাত জেগে লিখছো। সেই সাথে আবার কবরের মতো কবিতা। অনেক অদ্ভুত জিনিস তোমার মাথায় ঘুরছে। তাই কল্পনা করছো তুমি। এখন লিখাটা বন্ধ করো। আর ঘুমাও। ব্রেইনটা কে রেস্ট দাও।"
কিন্তু মিথিলা জানে, দরজা খোলার ব্যাপার টা তার কল্পনা বা হ্যালুসিনেশন কিছুই ছিলোনা।
এভাবে আবার কিছু দিন কেটে যায়।
মিথিলা আবার অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখে। স্বপ্নটা ছিলো এমন:
রফিক মিথিলার হাতে একটা পলিথিন এ কয়েকটি ডিম দেয়, যেন মাত্র রফিক বাজার করে এনেছে। মিথিলা ডিমগুলো কে কিচেনে রেখে বেডরুমে যায় এবং আবার ফিরে আসে কিচেনে। কিন্তু, মিথিলা দেখে কয়েকটি ডিম ফ্লোরে ভেঙে একাকার অবস্থা। আর একটা ভাঙা ডিমের পাশে সৈকত বসে আছে একটা কালো রঙের হাফ প্যান্ট পড়ে খালি গায়ে। যেন ডিম ফুটে সৈকত বের হয়েছে। তার গায়ে ডিমের আঠালো অংশ চপচপ করছে। কিন্তু সৈকত কে কেমন যেন ভয়ংকর দেখাচ্ছে। যেন সে মানুষের বাচ্চা না। চোখগুলো আকৃতি তে বড়। সারা শরীর সাদা রঙের। যেন কোনো রক্ত নেই। সৈকত মিথিলা কে দেখে হামাগুড়ি দিয়ে মিথিলার দিকে আসতে লাগলো আর 'মা' 'মা' বলতে লাগলো। মিথিলা ভয়ে দিলো এক দৌড়। কিন্তু, শুনতে পায় রফিকের চিৎকার।
এটুকুতেই ঘুম ভেঙে যায়। পাশে রফিক কে দেখতে পায় ঘুমের মধ্যে গোঙাচ্ছে। যেন সে-ও ভয়ংকর স্বপ্ন দেখছে। এমনিতেই মিথিলা ভয়ের স্বপ্ন দেখেছে, তার উপর রফিকের এই অবস্থা। রফিক কে জাপটে ধরে মিথিলা জোরে চিৎকার করলো। রফিকের শরীর ঝটকা মেরে ঘুম ভাঙলো। রফিক এর এই অবস্থা দেখে মিথিলা সব ভয় ছেড়ে উঠে পানির গ্লাস এনে রফিক কে পানি দেয়।
রফিক অত সহজে ভয় পাওয়ার মতো মানুষ না। মানুষ হিসেবে রফিক মোটামুটি ধার্মিক। মুখভর্তি দাড়ি, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া, মিথিলার প্রতি তার ভালোবাসা-শ্রদ্ধা, বাবা-মা কে সম্মান করা সব মিলিয়ে রফিক কে এসব ডর ভয় কাবু করবে এমন হতে পারে না।
রফিক কে জিজ্ঞেস করলো, "খারাপ স্বপ্ন দেখেছো?"
রফিক বিড়বিড় করে "আস্তাগফিরুল্লাহ" আর "লা হাওলা আলা কুয়াতা" পড়ে বাঁ দিকে থুথু ছিটিয়ে বলে,
"ঘুমাও। কাল সকালে বলবো।"
এই বলে রফিক আয়াতুল কুরসি পড়তে লাগলো। আর নিজের এবং মিথিলার গায়ে ফুঁ দিয়ে ঘুমিয়ে গেলো।
সকালবেলা মিথিলা আর রফিক প্রায় একসাথেই বের হয় নিজ নিজ কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে। মিথিলা কে রিকশায় স্কুলের সামনে নামিয়ে দিয়ে তারপর রফিক একই রিকশায় তার অফিসের সামনে গিয়ে নামে। মিথিলার স্কুল থেকে রফিকের অফিস বেশিদূর না। এই ২০ মিনিটের রাস্তা। রফিক মাত্রই নাস্তার টেবিলে বসেছে। মিথিলা খাবার বেড়ে দিতে দিতে বললো, "আচ্ছা, কাল কি স্বপ্ন দেখেছিলে যে, এত ভয় পেয়ে গেলে? তুমি তো কখনোই এমন করোনা। আমি কি পেত্নি হয়ে তোমার ঘাড় মটকানোর জন্য এসেছিলাম নাকি?"
রফিক হাসলো। বললো, "কালকের স্বপ্নটা ভয়ংকর না, কিন্তু অদ্ভুত। তবে মনে হচ্ছিলো যেন সত্যি সত্যি ঘটছে সবকিছু। স্বপ্নে দেখলাম, আমি ডিম কিনে বাসায় ফিরে তোমার হাতে ডিম দিলাম আর আমি বেডরুমে গেলাম। এরপর ব্যালকনিতে গেলাম। রেলিং এর পাশেই দাঁড়িয়ে নিচে তাকিয়ে দেখি একটা ছোট্ট ছেলে, কালো হাফপ্যান্ট পড়া আমাদের ব্যালকনির পাশের দেয়াল বেয়ে স্পাইডারম্যানের মতো উঠছে। এটা আহামরি কিছু না। কিন্তু, ছেলেটার লুক দেখে আমার কেন যেন খুব ভয় করতে লাগলো। যেন আমাদের কাছেই ওর আশ্রয়স্থল।"
মিথিলা খাবারটা মুখের ভেতরে ঢুকিয়ে রফিকের কথা শোনার পর থ হয়ে গেলো। কোনোরকম নিজেকে সামলে রফিক কে বললো, "ইবলিশ খারাপ স্বপ্ন দেখালে যা হয় আর কি! স্বপ্ন তো স্বপ্ন ই! Anyway, বের হতে হবে আমাদের।"
মিথিলা এবার স্বপ্নের আগাগোড়া মেলাতে লাগলো। অর্থাৎ, রফিক স্বপ্নে দেখেছে সে ডিমগুলো মিথিলার হাতে দিচ্ছে। আর মিথিলাও স্বপ্নে দেখলো, রফিক তাকে ডিম গুলো হাতে দিচ্ছে। এরপর রফিক দেখলো, রফিক বেডরুমে ঢুকছে। আর এর মধ্যে মিথিলা দেখলো, মিথিলা ডিমগুলো কে কিচেনে রাখছে।
রফিক এরপর ব্যালকনিতে চলে যায়। এজন্যই মিথিলা বেডরুমে গিয়ে কাউকে দেখেনি।
মিথিলা ফিরে এসে দেখে ডিম ভাঙা, সৈকত তার পাশে বসে তার দিকে তাকিয়ে আছে এবং হামাগুড়ি দিয়ে আসছে। মিথিলা দৌড় দিলো আর রফিকের চিৎকার শুনতে পেয়েছিলো। আর এদিকে রফিক ব্যালকনি থেকে দেখলো একটা বাচ্চা ছেলে দেয়াল বেয়ে ওদের ব্যালকনির দিকে আসছে। এজন্যই রফিক চিৎকার করেছে।
একই স্বপ্ন দু'জন দেখেছে, তবে ভিন্ন ঘটনায়। মিথিলা ভাবতে লাগলো, "Something is very very wrong."
এটা স্বাভাবিক স্বপ্ন নয়। কিন্তু, সবকিছু আরো পরিষ্কার করতে মিথিলা একটা প্ল্যান করলো।
রাতে রফিক বাসায় ফিরে হাতমুখ ধুয়ে মিথিলার পাশে এসে বসলে, মিথিলা রফিক কে তার মোবাইল থেকে সৈকতের একটা ছবি বের করে দেখিয়ে বললো, "বাচ্চাটা খুব কিউট না?"
রফিক এক নজর দেখেই "আস্তাগফিরুল্লাহ। লা হাওলা আলা কুয়াতা" বলে মিথিলার হাত থেকে ফোন টা এক ঝটকায় দূরে ফেলে দিয়ে বললো, "এইটা কে? একেই তো স্বপ্নে দেখেছি।"
মিথিলা গম্ভীর গলায় বললো, "ওকেই আমি পড়াই। ওর নাম ই সৈকত। মিসেস রায় এর ছেলে।"
রফিক আর মিথিলা অবাক হয়ে দু'জন দু'জনের দিকে তাকিয়ে রইলো।
মিথিলা আবারও বলে উঠলো, "কাল রাতে স্বপ্নে তুমি যা দেখেছিলে, আমিও তাই দেখেছি। তবে আমারটায় কিছু ডিফারেন্ট থাকলেও তুমি আর আমি যে সৈকত কে দেখেছি এটাই মেইন পয়েন্ট।"
রফিক কোনো কথাই বলছিলোনা। ফ্যালফ্যাল করে মিথিলার দিকে তাকিয়ে আছে।