রবিবার, ২ এপ্রিল, ২০২৩

 গল্প/কাহিনি: "টিউশনি" (পর্ব-১)

ঢাকার স্বনামধন্য একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের জুনিয়র সেকশনে পড়ায় মিথিলা (ছদ্মনাম)। মিথিলার ক্লাসে হিন্দু সম্প্রদায়ের একটা ছেলে পড়ে। নাম সৈকত রায় (ছদ্মনাম)। বয়স ৬/৭ বছর। সৈকত স্টুডেন্ট হিসেবে খুব ই ট্যালেন্টেড। সৈকতের বাবা মা- মিস্টার এন্ড মিসেস রায় (ছদ্মনাম) খুব ই নিরীহগোছের মানুষ। মিস্টার রায় ঢাকার মোটামুটি পরিচিত একটা কোম্পানির সিইও এবং মিসেস রায় হাউজওয়াইফ। তাদের একমাত্র ছেলে সৈকত।
শিক্ষকতার পেশায় যতই বলা হোক না কেন সব শিক্ষার্থীদের সমান চোখে দেখতে হবে। কিন্তু, তবুও কিছু শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষকদের মনে জায়গা করে নেয়। মিথিলার মনে সৈকত ঠিক তেমন ই একটা জায়গা দখল করে নিয়েছে। সৈকত মিথিলা কে তার মায়ের পরে খুব সম্মান করতো এবং মিথিলাও সৈকত কে তার ছেলের দৃষ্টিতে দেখতো।
কারণটা অজানা। কিন্তু, সৈকতের চাহনিটাই যেন কেমন। কিছু মানুষ আছে, যারা কিছুক্ষণ কথা বললে এমনকি তাকিয়ে থাকলেই লোকেরা তাকে স্নেহ করতে কিংবা মায়া করতে শুরু করে। সৈকতের চেহারাটাও ঠিক এমন ই কিউট। যে কেউ সৈকতের সাথে ১০ মিনিট কাটালেই তাকে "লক্ষ্মী একটা বাচ্চা" বলতে বাধ্য হবে।
কিন্তু, সৈকত যে বার ভর্তি হয়েছিল সেটা ছিলো সেশনের একদম মাঝখানে অর্থাৎ একেবারে হুট করেই সৈকত ভর্তি হলো এই স্কুলে। কারণ হিসেবে মিস্টার রায় এর ঢাকায় হঠাৎ ট্রান্সফারেশন এর কারণ টা ই সবার কাছে তুলে ধরা হলো। তবে সৈকত ৬ মাসে ১ বছরের সিলেবাস শেষ করে একদম গলধকরণ করে ফেললো, যা সবাই সৈকতের "গড গিফটেড ব্রেইন" হিসেবে ধরে নিলো।
যা-ই হোক, এটা নিয়ে আর কেউ চিন্তা করেনি।
একদিন স্কুল ছুটির পর সৈকতের মা অর্থাৎ মিসেস রায় মিথিলার সাথে কথা বলতে চাইলেন।
মিসেস রায়: মে আই কাম ইন, ম্যাডাম?
মিথিলা: হ্যা, শিওর। হ্যালো, মিসেস রায়! ভালো আছেন?
মিসেস রায়: জি, ম্যাডাম। আপনি?
মিথিলা: হ্যা, আছি উপরওয়ালার বরকতে।
মিসেস রায়: ম্যাডাম, আপনার সাথে একটা ব্যাপারে ডিসকাস করার দরকার ছিল। আর একমাস পর সৈকত নতুন ক্লাসে উঠবে। সেই সাথে নতুন পড়া। আমি চাচ্ছিলাম, সৈকতের জন্য একটা হোম-টিউটর রাখতে। কিন্তু সত্যি কথা বলতে গেলে যদি আপনি একটু সৈকতকে সময় দিতেন আমাদের বাসায়! ও আপনাকে খুব পছন্দ করে। ওর ফেভারিট টিচার নাকি আপনি। বেশি না ১ ঘন্টা পড়লেই এনাফ।
মিথিলা রাজি হতে চাচ্ছিলো না। কারণ, স্কুল এর টিচারদের কোন স্টুডেন্ট কে বাসায় গিয়ে পড়ানোর নিয়ম নেই। কিন্তু, সৈকত এর উপর মিথিলার আলাদা একটা মায়া কাজ করে সবসময়। তাই, মিসেস রায় কে বললো, "আমাকে আজকের দিনটা সময় দিন। আমি আপনাকে আগামীকাল জানাচ্ছি।"
মিসেস রায় হাসিমুখে বললেন, "আমি কিন্তু আপনার অপেক্ষায় থাকবো। আর যদি আপনি রাজি হন, আমি গ্যারান্টি দেবো আপনার টিউশনির কথা এই স্কুলের কাকপক্ষী ও টের পাবেনা। আপনি আপনার পছন্দমতো পেমেন্ট ও পাবেন। এটা নিয়ে চিন্তা করবেন না।"
মিথিলা তবুও বললো, "না, না। ঠিক আছে। কিন্তু আমার ও তো শিডিউল এর ব্যাপার আছে। আমি এজন্যই আপনাকে বললাম, আগামীকাল ফাইনালি জানাবো।"
মিসেস রায় হাসিমুখে চলে গেলেন।
মিথিলা বাসায় তার হাজবেন্ড এর সাথে কথা বললে তার হাজবেন্ড জানায়, "যদি তুমি চাও আর ভদ্রমহিলা যেহেতু তোমার সিক্রেট এর গ্যারান্টি দিয়েছেন তাহলে করতে পারো। ওদের বাসা তো তেমন দূরে নয়। আর উনিও তো হাউজওয়াইফ। বাসাতেই থাকবেন। তাই মনে হয় টিউশনিটা সিকিউরড। স্টার্ট করতে পারো।"
মিথিলা পরদিন সম্মতি জানিয়ে দিলো। মিথিলা স্কুল থেকে বের হয় দুপুর ১টায়। ঠিক করা হলো, স্কুল থেকে সৈকতের বাসায় যাবে পড়াতে। তারপর টিউশনি শেষ করে একেবারে বিকেল ৩টায় বাসায় ফিরবে।
মিসেস রায় খুব ই পরিচ্ছন্ন আর পরিপাটি মানুষ। যে বিল্ডিং এ উনাদের ফ্ল্যাট, তা দেখলে বোঝা যায় মোটামুটি বড়লোক গোছের পরিবার। বড়লোক না হলে ছেলে কে এরকম স্কুলে পড়াতে পারে? তার উপর শোনা যায়, এই ফ্ল্যাট টা মিস্টার রায়ের নিজের ই। ব্যক্তিগত গাড়িও আছে।
মিথিলা যে সময়টায় পড়ায়, সেটা লাঞ্চ টাইম। তাই, বেশিরভাগ সময়েই মিসেস রায় মিথিলাকে উনাদের বাসায় আগে লাঞ্চ সেরে নেয়ার অফার করে। মিথিলা মানা করলেও মিসেস রায় মোটামুটি সুস্বাদু আর হেলদি নাস্তা দেন যাতে মিথিলার লাঞ্চের খুদাটা নিবারণ হয়।
তবে, একমাস যাবার মধ্যেই মিথিলা একটা জিনিস লক্ষ্য করে। মিথিলার যেদিন যে স্বাদের খাবার খেতে ইচ্ছে করে, সেটা না বলা কিংবা না জানানো স্বত্ত্বেও মিসেস রায় কাকতালীয় ভাবে সেদিন ওই স্বাদের খাবার ই সামনে এনে হাজির করেন। যেমন: একদিন মিথিলা সকাল থেকে কিছুই খায়নি। সৈকতের বাসায় যেতে যেতে ভাবছিলো,
"আজ বাসায় ভর্তা-ভাজির আইটেম রান্না করবে। কতদিন শুটকিভর্তা খাওয়া হয়না!"
সৈকতের বাসায় গিয়ে সোফায় বসা মাত্রই মিসেস রায় অপোজিট সোফায় বসে বললেন, "ম্যাডাম, আজ লাঞ্চ করুন আমার সাথে। বাসায় তেমন কিছু যদিওবা রান্না করিনি। কিন্তু গরমভাত, শুটকিভর্তা, ইলিশমাছ ভাজা আর বেগুনভাজা আছে। সৈকতের বাবা ঢাকার বাইরে গেছে। তাই কোনো পুরুষ মানুষ ও আসবেনা। আপনি হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হোন। আমিও এখনো লাঞ্চ করিনি। আসুন, একসাথে খাই। খাওয়াদাওয়া সেরে তারপর ওকে পড়াবেন।"
মিথিলার মনে ধাক্কা খেলো। ভাবলো, "এটা কি কাকতালীয় কোনো ব্যাপার? উনি কি করে জানলেন আজ মিথিলার ভর্তা-ভাজি খেতে ইচ্ছে করছে? নাকি মিসেস রায় মাইন্ড-রিড করতে পারেন?"
অবাক করে দিয়ে মিসেস রায় বললেন, "আমি জানি আপনি শুটকিভর্তা পছন্দ করেন। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হোন। আমি ঝটপট খাবার রেডি করছি। লাঞ্চ না করলে কিন্তু খুব রাগ করবো।"
মিথিলা আর না করতে পারলোনা। যেহেতু খুদায় পেট চো চো করছে, তাহলে খেয়ে নেয়াটাই বেটার। ওয়াশরুমে গেলো এবং ফ্রেশ হলো। বড়জোর ২/৩ মিনিট সময় লেগেছে।
বের হয়ে দেখলো, মিসেস রায়ের টেবিলে সব খাবার খুব সুন্দর করে সাজানো। কিন্তু, একটু আগেই তো পাশের সোফায় বসে কথা বললো। তখন তো ডাইনিং টেবিল টা খালি ছিলো। এত তাড়াতাড়ি উনি খাবার গরম করে সেটা আবার পাত্রে সাজিয়ে কিভাবে টেবিলে পরিবেশন করলেন?
আবার ভাবলো, হয়তো আগে থেকেই খাবারগুলো বাটিতে রাখা ছিলো অথবা কিচেনে ছিলো খাবারগুলো। মিথিলা ওয়াশরুমে ঢোকামাত্র ই মিসেস রায় টেবিলে এনে সাজিয়েছেন।
মিসেস রায় আবারো বললেন, "তাড়াতাড়ি বসুন ম্যাডাম। খাবার ঠান্ডা হয়ে যাবে।"
মিথিলা খেতে খেতে খাবারের স্বাদ বুঝে যা বুঝলো, যেন মাত্র খাবারগুলো রান্না করে চুলা/ওভেন থেকে নামানো হয়েছে। এত তাড়াতাড়ি কিভাবে সেটা সম্ভব? মনে হয় ওভেনে গরম করা।
মিসেস রায় মিথিলা কে জিজ্ঞেস করলেন, "ম্যাডাম, আপনার বাসায় কি মাইক্রোওভেন আছে?"
মিথিলা জবাব দিলো, "না কিনিনি। তবে কেনার চিন্তাভাবনা আছে। নতুন সংসার আমাদের। টোনাটুনির সংসার যেরকম হয় আর কি!"
মিসেস রায় বললেন, "কিনে ফেলেন ম্যাডাম। খাবার ৩/৪ মিনিটে গরম করে ফেলা যায়। সময়টা বাচে আর গ্যাস খরচ ও কমলো।"
মিথিলা ১ বার আড়চোখে তাকালো মিসেস রায় এর দিকে। মিসেস রায় ইলিশ মাছের কাটাসহ কচকচ করে খাচ্ছেন। তার গলায় কোনো কাটা বিধছে না।
মিসেস রায় বললেন, "মাছ আবার আমাদের খুবই পছন্দ, বুঝলেন ম্যাডাম! আমরা প্রতিদিন ই কোনো না কোনো মাছ খাবারের আইটেমে রাখি।"
(চলবে)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

  গল্প/কাহিনি: "টিউশনি" (পর্ব:৩) ------------------------------------------- মিথিলার কপালে এবার চিন্তার ভাজ পড়লো। আর উপায় খুঁজে না...